প্রথম আলো :: হেফাজতে ইসলামের বিক্ষোভ, সংঘাত এবং তাদের ডাকা হরতালে পুলিশসহ বিভিন্ন আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর ‘সহায়ক’ শক্তি হিসেবে আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীদের মাঠে থাকা নিয়ে দলের ভেতরেই কথা উঠেছে। ঢাকার বায়তুল মোকাররমসহ কোথাও কোথাও হেফাজতের কর্মীদের সঙ্গে সংঘর্ষেও জড়িয়েছেন সরকারি দলের কর্মীরা। এটাকে সংঘাতে ‘উসকানি’ হিসেবেও দেখছেন অনেকে।
আইনশৃঙ্খলা নিয়ন্ত্রণে দলীয় কর্মীদের মাঠা থাকা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে কোনো ভূমিকা রাখতে পারেনি, উল্টা উত্তেজনা ছড়িয়েছে—এমন আলোচনাও আওয়ামী লীগে রয়েছে। দেশে এতগুলো আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী থাকার পরও পরিস্থিতি সামাল দিতে কেন দলের কর্মীদের নামাতে হলো, সেই প্রশ্নও সামনে এসেছে।
আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় নেতাদের কারও কারও মতে, নেতা-কর্মীদের এভাবে মাঠে নামানোর কারণে মনে হতে পারে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর ওপর সরকার বা দলের পুরোপুরি আস্থা নেই। অথবা আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সক্ষমতায় ঘাটতি দেখা দিয়েছে। মানুষের মনে এ ধরনের ধারণা তৈরি হলে তা বিপজ্জনক হবে।
আওয়ামী লীগের দায়িত্বশীল একজন নেতা নাম না প্রকাশের শর্তে প্রথম আলোকে বলেন, ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির সফরবিরোধী বিক্ষোভ এবং এটাকে কেন্দ্র করে সংঘাত মোকাবিলা আইনশৃঙ্খলাসংক্রান্ত বিষয়। ফলে রাজনৈতিক শক্তি হিসেবে আওয়ামী লীগের এখানে সারসরি সম্পৃক্ত হওয়ার প্রয়োজন ছিল না। অতীতে বিএনপি-জামায়াতের হরতাল-অবরোধসহ জ্বালাও–পোড়াও কর্মসূচিতে দলীয় নেতা-কর্মীদের মাঠে রাখার জোর চেষ্টা ছিল। কিন্তু তখনো সেভাবে নেতা-কর্মীদের মাঠে নামানো যায়নি।
মোদিবিরোধী কর্মসূচি ও হেফাজতের হরতালে যুবলীগ, ছাত্রলীগ ও স্বেচ্ছাসেবক লীগের নেতা-কর্মীদের মাঠে নামাতে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর মাঠপর্যায়ের কিছু কর্মকর্তার উৎসাহ ছিল বলেও জানা গেছে। এর মধ্যে যুবলীগের নেতা-কর্মীদের মাঠে থাকার জন্য সংগঠনের শীর্ষ পর্যায় থেকে নির্দেশনা ছিল। এ বিষয়ে যুবলীগের কেন্দ্রীয় সাধারণ সম্পাদক মাইনুল হাসান খান (নিখিল) প্রথম আলোকে বলেন, সাম্প্রতিক এই কর্মসূচিতে হেফাজত, বিএনপি ও জামায়াত একাকার হয়ে গেছে। অতীতে এরা আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকেও হত্যা করতে দ্বিধা করেনি। এমন কর্মসূচিতে জনগণ ও রাজনৈতিক শক্তি মাঠে থাকলে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ভরসা পায়। এ জন্যই তাঁরা নেতা-কর্মীদের সতর্ক থাকতে নির্দেশনা দিয়েছিলেন।
আর হেফাজতের কর্মসূচি ঘিরে নেতা–কর্মীরা সজাগ ছিলেন বলে জানান স্বেচ্ছাসেবক লীগের কেন্দ্রীয় সাধারণ সম্পাদক আফজালুর রহমান।
তবে বিএনপি বলছে, সরকার দলীয় কর্মীদের মাঠে নামিয়ে সংঘাতে উসকানি দিয়েছে। দলের মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর গত মঙ্গলবার সংবাদ সম্মেলন করে এই দাবি করেছেন।
অন্যদিকে হেফাজতে ইসলামের নেতারা বলছেন, ২৬ মার্চ বায়তুল মোকাররমে জুমার নামাজের পর মোদিবিরোধী বিক্ষোভে সরকারি দল হামলা না করলে পরিস্থিতি সংঘাতময় হতো না। সংগঠনটির দাবি, মুসল্লিদের মিছিলে সরকারি দল হামলা করেছে, এই ভিডিও চিত্র দেখে হাটহাজারীতে মাদ্রাসার ছাত্ররা বিক্ষোভ মিছিল বের করেন। তাতে পুলিশ বাধা দিলে সংঘর্ষ বাধে। সেখানে পুলিশের গুলিতে চারজন নিহত হন। এর জেরে ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় মাদ্রাসার ছাত্ররা মাঠে নামেন। ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় টানা তিন দিন সহিংসতায় ব্যাপক হামলা, ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগের ঘটনা ঘটেছে। সেখানে নিহত হয়েছেন মোট ১২ জন।
বায়তুল মোকাররমে সংঘাতের ঘটনার ভিডিও ফুটেজে পুলিশ ও ক্ষমতাসীন দলের নেতা–কর্মীদের পাশাপাশি অবস্থানে দেখা গেছে। পরিস্থিতি সামাল দিতে দলীয় নেতা–কর্মীদের কেন সঙ্গে নিতে হলো, এ ব্যাপারে জানতে চাইলে ঢাকা মহানগর পুলিশ কমিশনার (ডিএমপি) মোহা. শফিকুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, ‘সেদিন (২৬ মার্চ) মসজিদে অনেকেই নামাজ পড়তে এসেছেন, তাঁরা ছাত্রলীগ না যুবলীগ পুলিশ তো কাউকে চেক করে ঢুকায়নি। রাজনৈতিকভাবে তারা কী করবে, সে সিদ্ধান্ত তো আমি দেইনি। ভারতের প্রধানমন্ত্রীর নরেন্দ্র মোদির নিরাপত্তা নিয়ে বেশির ভাগ ফোর্স ব্যস্ত ছিল। আশঙ্কা ছিল তেমন কিছু হতে পারে, তখন পরিস্থিতি সামাল দেওয়া কঠিন হবে। তাই বলে এইটা না যে, কাউকে বলব, আপনি এসে আমার পক্ষে মারামারি করেন।’
ডিএমপি কমিশনার বলেন, সবচেয়ে বড় আন্দোলনও পুলিশ সফলতার সঙ্গে মোকাবিলা করেছে। তাহলে কাউকে কি আর ডাকার প্রয়োজন আছে?
এদিকে আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য ও কৃষিমন্ত্রী আব্দুর রাজ্জাক প্রথম আলোকে বলেন, দলীয় কর্মীদের মাঠে থাকার বিষয়টি আগে থেকে সিদ্ধান্ত নিয়ে হয়নি। নেতা-কর্মীদের সব সময়ই সতর্ক থাকতে বলা হয়েছে। সতর্কতা থেকেই হয়তো তাঁরা প্রতিবাদ করার চেষ্টা করেছেন। তিনি বলেন, হেফাজতে ইসলাম যেভাবে তাণ্ডব চালিয়েছে, সেটা খুবই বিপজ্জনক। এটা চলতে দেওয়া যায় না।
মোদিবিরোধী বিক্ষোভে এবার ক্ষমতাসীন দলের নেতা-কর্মীরা প্রথম শক্তি দেখায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায়। গত ২৫ মার্চ রাতে ‘প্রগতিশীল ছাত্র সংগঠনসমূহ’ ব্যানারে বামপন্থী ছাত্রসংগঠনের মোদিবিরোধী বিক্ষোভে হামলা চালান ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীরা। ওই ঘটনায় কয়েকজন সাংবাদিকও আহত হন।
পরে রোববার হেফাজতের ডাকা হরতালে ঢাকার বিভিন্ন এলাকায় ও ঢাকার বাইরেও আওয়ামী লীগ ও সহযোগী সংগঠনের নেতা-কর্মীদের মাঠে দেখা গেছে। অনেক জায়গায় তাঁদের হাতে লাঠিসোঁটাও ছিল। ওই দিন কয়েকটি স্থানে সরকারি দলের নেতা-কর্মীদের সঙ্গে হেফাজতের নেতা–কর্মীদের পাল্টাপাল্টি ধাওয়ার ঘটনা ঘটে।
আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মাহবুব উল আলম হানিফ প্রথম আলোকে বলেন, নৈরাজ্য, ধ্বংসযজ্ঞ ও জ্বালাও-পোড়াওয়ের বিরুদ্ধে সব সময় আওয়ামী লীগ সোচ্চার। এ ধরনের ঘটনা ঘটলে আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীরা তো বসে থাকবেন না। প্রতিবাদ করবেনই। আওয়ামী লীগ কোনো দল বা সংগঠনকে লক্ষ্য করে কর্মসূচি নেয় না। ঘটনার প্রতিক্রিয়া দেখায়।
দলীয় সূত্র জানায়, ২৬ মার্চ বায়তুল মোকাররম এলাকায় ধর্মভিত্তিক দলের সঙ্গে সংঘাতে জড়ান ঢাকা মহানগর আওয়ামী লীগ ও এর সহযোগী সংগঠনের নেতা-কর্মীরা। তাঁদের অনেকে আহতও হয়েছেন। এর মধ্যে খিলগাঁও এলাকার একজন নেতার অবস্থা এখনো আশঙ্কাজনক।
আওয়ামী লীগের একজন কেন্দ্রীয় নেতা নাম প্রকাশ না করার শর্তে প্রথম আলোকে বলেন, নরেন্দ্র মোদির সফর ও উদ্ভূত পরিস্থিতি মোকাবিলায় পুলিশের পাশাপাশি বিজিবিও নামানো হয়। অতীতে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর এর চেয়েও বড় বিক্ষোভ-সংঘর্ষ মোকাবিলা করেছে। কিন্তু এবার কেন দলীয় নেতা-কর্মীদের নামানো হলো তা বোধগম্য নয়।
এ বিষয়ে পুলিশের সাবেক মহাপরিদর্শক (আইজিপি) ও আওয়ামী লীগের সাংসদ নূর মোহাম্মদ প্রথম আলোকে বলেন, বাংলাদেশ পুলিশের এখন যে সুযোগ-সুবিধা, সক্ষমতা; তা দিয়ে নিঃসন্দেহে এ ধরনের পরিস্থিতি সামাল দেওয়া সম্ভব। এরপরও বিরোধী পক্ষের কর্মসূচিতে সরকার–সমর্থক রাজনৈতিক নেতা–কর্মীরা মাঠে থাকার চেষ্টা করেন, এটা অতীতেও হয়েছে, এখনো হচ্ছে। তবে আইনশৃঙ্খলাসংক্রান্ত বিষয় দেখার জন্য পেশাদার বাহিনীই যথেষ্ট।
পাঠকের মতামত: